দর্পণ ডেস্কঃ সিলেটের চাঞ্চল্যকর কিশোর বিনাম হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে সবই করেছিল মূল ঘাতক পাভেল আহমদ। আলোচিত এ খুনের ঘটনার পর সে সিলেট থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে নাম বদলে নতুন নামে পরিচিতি গড়ে তোলে। পাশাপাশি সিলেটে তার বিরুদ্ধে হয়েছিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। সেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সে ‘তামাদি’ করে ফেলে।
এরপর সিএনজি অটোরিক্সা চালক হিসেবে সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ৫ বছরের মধ্যে তার নাগাল পায়নি কেউ। অবশেষে সিলেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ‘সন্দেহভাজন’ আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার এসআই আবদুল মোতালেব।
আলোচিত বিনাম হত্যা মামলার ঘটনাটি ঘটেছিল সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে। ২০১৫ সালের ১৬ই আগস্টের ঘটনা। নিহত বিনাম হোসেনের বয়স তখন ছিল ১৪ বছর। অভাব-অনটনের সংসারে চা দোকানি ছিল বিনাম। উপজেলা সদরে সে চা দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। বিনামের বাড়ি লাছুখাল গ্রামে। তার পিতা আলী আহমদ। পাভেল আহমদের মূল বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ভাদুরপুরে।
ঘটনার কয়েক বছর আগে থেকে পাভেল বসবাস করতো কোম্পানীগঞ্জে। এ কারণে বিনাম হোসেনের দোকানে সে প্রায়ই আড্ডা দিতো। এ কারণেই বিনামের সঙ্গেও তার সংখ্য গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন সময় সে বিনামের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। এতে করে প্রায় ১০ হাজার টাকা বকেয়া পড়ে পাভেলের কাছে। এই টাকা চাইতে গিয়ে বিনামের সঙ্গে বিরোধ বাধে। এই বিরোধের সূত্র ধরে বিনামকে হত্যার পরিকল্পনা করে পাভেল। পরিকল্পনা মতো- পাভেল হোসেন ২০১৫ সালের ১৬ই আগস্ট রাতে তারই সহপাঠী বুড়দের গ্রামের শামসুজ্জামান, নুরুজ্জামান ও মো. শাহীন মিয়াকে নিয়ে ‘পার্টির’ কথা বলে বিনামকে উপজেলা পরিষদ এলাকায় নিয়ে আসে। সেখানে নির্জন স্থানে তারা বসে মাংসের সঙ্গে মদও পান করে। সব আয়োজন করে পাভেল আহমদ। রাত গভীর হলে পাভেলসহ তার অপর তিন সহযোগী বিনামকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। পরে লাশ গুম করতে উপজেলা পরিষদের পাশের নির্জন স্থানে বালিচাপা দেয়। এদিকে বিনামকে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন তার পরিবারের লোকজন। বিনামের সন্ধান কামনা করে তিনি থানায় জিডি করেন। পুলিশসহ এলাকার মানুষ খোঁজ করলেও পাননি বিনাম হোসেনকে।
৫ দিন পর স্থানীয়রা বালিচাপা দিয়ে রাখা বিনামের লাশের একাংশ দেখতে পান। পরে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ জুড়ে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। কিন্তু বিনাম খুনের ঘটনার পরদিনই কোম্পানীগঞ্জ ছেড়ে পালায় ঘাতক পাভেল আহমদ। ঘটনার পর বিনামের পিতা আলী আহমদ বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। লাশ উদ্ধারের পর কোম্পানীগঞ্জের বুড়দের গ্রামের শামসুজ্জামান, নুরুজ্জামান ও মো. শাহীন মিয়া নামে তিনজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে তারা হত্যার কথা স্বীকার করে। ওইদিনই ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর বিনামের বাবার জিডি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। ওই মামলায় শামসুজ্জামান, নুরুজ্জামান ও শাহীন মিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই বছরের ১লা সেপ্টেম্বর সিলেটের মুখ্য হাকিম আদালতে বিনাম হত্যা মামলার আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে তারা জানায়, বিনাম হোসেন তাদের এক বন্ধু পাভেলের কাছে ১০ হাজার টাকা পেত। বিনাম তার পাওনা টাকা ফেরত চাইলে পাভেল ক্ষুব্ধ হন। এক পর্যায়ে টাকা দেয়ার কথা বলে ১৬ই আগস্ট রাতে বিনামকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ-সংলগ্ন বেসরকারি একটি এনজিওর কার্যালয়ের পাশে খালি জায়গায় নেয়া হয়।
সেখানে পাভেলসহ চারজন গল্পের ছলে বিনামকে মদ পান করান। এরপর পেছন থেকে রড দিয়ে বিনামের মাথায় আঘাত করে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিনামের গলা কেটে ফেলা হয়। এরপর লাশ গুম করতে বালুচাপা দেয়া হয়। এদিকে আলোচিত এ খুনের ঘটনার পর পুলিশ বিনাম হত্যা মামলায় পলাতক পাভেল আহমদকে প্রধান আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। চার্জশিটে শামসুজ্জামান, নুরুজ্জামান ও শাহীন মিয়াকেও ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। ওই সময় শামসুজ্জামান, নুরুজ্জামান ও শাহীন মিয়া কারাগারে ছিল। পরে তারা আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। আর ২০১৬ সালে আদালত পলাতক থাকা আসামি পাভেল আহমদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। কিন্তু কোম্পানীগঞ্জ থানা থেকে ওই সময়ই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ‘তামাদি’ করা হয়। ফলে আলোচিত এ ঘটনার প্রধান আসামি পাভেল আহমদ ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। এদিকে সিলেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার এসআই আবদুল মোতালিব গত ১৫ই আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে গ্রেপ্তার করেন প্রধান আসামি পাভেল মিয়াকে। তাকে আটকের পর কোম্পানীগঞ্জ থানার ওয়ারেন্টের আসামি হিসেবে খোঁজ করলেও এর সত্যতা মেলেনি। কোম্পানীগঞ্জ থানায় পাভেল নামে কারো বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই বলে জানিয়ে দেন ওসি কেএম নজরুল।
ওসি জানিয়েছেন, বিনাম হত্যা মামলায় পাভেল নামে একজন আসামি ছিল। কিন্তু থানায় তার নামে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই। এ কারণে পাভেল গ্রেপ্তার হওয়ার খবর জানলেও আইনিভাবে তারা তাকে সমঝে নিতে পারেননি। এদিকে পাভেলকে গ্রেপ্তার করলেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানা পুলিশ। অভিযানের নেতৃত্বদানকারী এসআই আবদুল মোতালিব জানিয়েছেন- গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না পেয়ে বিনাম হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাভেলকে আদালতে সোর্পদ করা হয়। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। এদিকে- চাঞ্চল্যকর বিনাম হত্যা মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট আবদুস সুবহান জানিয়েছেন, বিনাম হত্যা মামলাটি এখন বিচারিক পর্যায়ে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ২০১৬ সালেই প্রধান আসামি পাভেলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তারের পর পরোয়ানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি জানান, এ কারণে পাভেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রেপ্তারের পর সিলেটের জজ আদালত থেকে নতুন করে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। আগামী ২৬শে আগস্ট এ মামলার ধার্য তারিখ রয়েছে। ওইদিন প্রধান আসামি পাভেলকে আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে। তিনি জানান, বিনাম হত্যা মামলায় পাভেল ঘটনার পর থেকে পলাতক ছিল। অন্য তিন আসামি কারাগারে ছিল। পরবর্তীতে আদালত থেকে তারা জামিনে রয়েছে।