সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ১০:০৭ পূর্বাহ্ন

বিজ্ঞপ্তিঃ
আমাদের সিলেট দর্পণ  ২৪ পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে , আমাদেরকে আপনাদের পরামর্শ ও মতামত দিতে পারেন news@sylhetdorpon.com এই ই-মেইলে ।
জীবনের গল্প; ট্রাকের হেলপার থেকে বিসিএস ক্যাডার

জীবনের গল্প; ট্রাকের হেলপার থেকে বিসিএস ক্যাডার

বিশেষ প্রতিবেদন:: ২০০৫ সাল।এসএসসি পরিক্ষা শেষে আগের মত ট্রাকের হেলপারিতে চলে যায় ছেলেটি।এক দিন  রেজাল্ট প্রকাশ হলো।ছেলেটি তাঁর রেজাল্ট জানতে পারেনি। সেদিনও ছেলেটি ট্রাকের হেলপার হিসেবে ট্রাকের সঙ্গে মালামাল পরিবহনে দূর থেকে অনেক দূরে ছিল।পরদিন তার বাড়ি ফেরা হলো।বাড়িতে এসে জানল এক আজব খবর! সেনাকি পুরো কুড়িগ্রাম জেলায় মানবিক বিভাগ থেকে ২০০৫ সালে একমাত্র জিপিএ ফাইভ পেয়েছে।তখন কিন্তু জিপিএ  ফাইভ এতো সহজলভ্য ছিলনা। সে জন্য পুরো জেলায় সে ছিল মানবিক বিভাগে নিজের উদাহরণ।

এক পর্যায়ে সংগীত শিল্পী কনক চাঁপা এই অদম্য মেধাবী ছেলেটির এমন চমকপ্রদ ফলাফলের সংবাদ শুনে তাকে সাত হাজার টাকা শুভেচ্ছা হিসেবে পাঠিয়ে ছিলেন।তারপর বিভিন্ন বৃত্তি পেয়ে সে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে।২০০৭-০৮ সেশনে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে।

কুড়িগ্রাম জেলার হত দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে যার নিয়তি ছিল বাবা আব্দুল খালেকের মত জলিল বিড়ির ফ্যাক্টরিতে কাজ করার।কিংবা ট্রাকের হেলপার থেকে ড্রাইভার হওয়ার! বিড়ির ধোঁয়ায় ঝাপসা আর গন্ধ তাকে আটক করে বাবার পাশে রাখার কথা সত্ত্বেও রাখতে পারেনি। নিয়তির সেই ট্রাক যে তাকে হেলপারের সার্টিফিকেট দিয়ে ছিলো, সে ড্রাইভারের সার্টিফিকেট দিতে পারেনি।যদিও কথা ছিল তার দুটি থেকে একটিতে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার।

বিড়ি ফ্যাক্টরির শ্রমিক বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর পড়াশোনা করে বড় হোক।তাই প্রাইমারি শেষে ফ্যাক্টরির কাজে না এনে ভর্তি করেন হাই স্কুলে।আশপাশের লোকজন তা নিয়েও করে ছিল তাচ্ছিল্য! গরীবের ছেলে বলে নিরবে সইতে হয়েছিল আশেপাশের মানুষের অবহেলা আর তাচ্ছিল্যকর কত কি।

ক্লাস সিক্সে উঠার পর স্কুলের বেতন না দিতে পেরে স্কুল ছাড়ার উপক্রম হয়।বাবার স্বাদ থাকার পর সাধ্য নাই বলে এই পরিস্থিতি।এমন সময় এগিয়ে এলেন একজন মহানুভব শিক্ষক।মোজাফফর আলী স্যার! তিনি ছেলেটির বেতন দিয়ে টিকিয়ে রাখলেন।এরপর বিনাবেতনে পড়াশোনা করার ব্যবস্থাও করে দিলেন।

ছেলেটি অকপটে স্বীকার করেছে মাত্র এক জোড়া প্যান্ট শার্ট দিয়ে পুরো স্কুল জীবন পার করতে হয়েছিল। স্কুলে একবার নিয়ম করা হলো পায়ে জুতো ছাড়া কেউ স্কুলে আসতে পারবে না। অনন্যোপায় ছেলেটি স্কুলে গেল উদোম পায়ে। বসল সবার পেছনে যাতে শিক্ষকের নজর তার দিকে না পড়ে।

সেই দিন শিক্ষক বেত হাতে নিয়ে ঘোষণা করলেন- আজ যারা জুতো ছাড়া এসেছো তারা ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও। আর যারা পরদিন জুতো পরে আসতে পারবে না তাদের স্কুলে আসার কোন দরকার নেই। পরদিন কেউ আর মিস করবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে কজন জুতো আনেনি তারা রক্ষা পায়। কিন্তু পেছনে বসা ছেলেটি অঝোরধারায় কাঁদতে থাকে।আর মনেমনে ভাবে আজকের দিনই তার স্কুল জীবনের শেষ দিন। কেননা,তার ভাগ্যে একজোড়া জুতো কেনার স্বপ্ন মানে সে এক মহা ভারত ব্যাপার!

ছেলেটির অসহায় কান্না দেখে সেদিন ক্লাসের সবাই সিদ্ধান্ত নিল বাকি সবে মিলে তাকে এক জোড়া জুতো কেনার টাকা আগামীকালই জোগাড় করে দিবে।এরপর হলো তার জুতো কেনা।তাকে ছাড়তে হলোনা বিদ্যালয়।

এরপর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়,তখন সে বঙ্গবন্ধু হলে আবাসিক ছাত্র হিসাবে উঠে। সেই দিন থেকে শুরু হয় তার আরেক নতুন জীবন। সহস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আরেক নতুন সংগ্রাম, এ সংগ্রাম যেন মহা সংগ্রাম।একে একে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে অগ্রসর হতে থাকে আগামীর পথে।

নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে সে ঢাকা শহরে বিভিন্ন কোম্পানির লিফলেট বিলির কাজ শুরু করে।এরপর কম্পিউটারের কাজ শিখে অপারেটর হিসেবে কাজ করতে থাকে।প্রতিদিন দু’মুঠো ভাত কিংবা দুই পিস রুটি খেয়ে বেঁচে থাকা যার কাছে ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ; সে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলে তার পাশে দাড়াতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ আর  অনেক মানবিক মানুষজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ছেলেটি বিসিএসের ভাইভা দেবে।মনে পড়ে সেই স্কুলের জুতো কাহিনী। যেন অপমানের নিয়তি তাঁর পেছন ছাড়ছেনা। ভাইভার জন্য ফরমাল কোন ড্রেস নেই।কমদামি হাতেগোনা কয়েকটি জামা কাপড়!নেই ভালো এক জুড়ো জুতো!কি করে যাবে ভাইভা বোর্ডের সামনে।তাই লজ্জা ভেঙে পরিচিত সামর্থ্যবান একজনের কাছে এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে দেয়ার জন্য ছেলেটি সাহায্য চেয়েছিল। সাহায্য দূরে থাক উল্টো চরম অপমান সইতে হয়েছিল সেদিন তাকে।

অতঃপর সেই ছেলেটি ৩৫তম বিসিএসের ভাইভা দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করে। অদম্য সংগ্রামী জীবনের অধিকারী এই ছেলেটির নাম মো. শফিকুল ইসলাম। কুড়িগ্রাম জেলা সদরের পলাশবাড়ির চকিদার পাড়ায় তার জন্ম। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শফিকুল পরিবারের চতুর্থ সন্তান।এক সময়ের ট্রাকের হেলপার ছেলেটি এখন নিজ জেলার পাশের জেলা লালমনিরহাট সরকারি মজিদা খাতুন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার।

তিনি মনে করেন, ট্রাকের হেলপার থেকে বিসিএস ক্যাডার হওয়া লজ্জার কোন বিষয় নয়।আজো বৃষ্টি হলে চালা চুষে টপটপ করে ঘরে পানি পড়ে।এই পানি পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি দেখেন আরো এক পৃথিবী।তিনি মনে করেন দারিদ্র্যের এক অদৃশ্য শক্তি আজ তাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

তাঁর এই সংগ্রামের পথচলায় যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তাদের কৃতজ্ঞচিত্তে সে স্মরণ করে। সেই তালিকায় আছেন তার পাশের বাড়ির মাহবুবুর রহমান লিটন, ডলার ভাই, ব্যাংকার মোজাহেদুল ইসলাম শামীম, মুক্তি আর্ট, বানিয়া পাড়ার লাবলু স্যার, কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মোজাফফর স্যার, মান্নান স্যার,মমতাজ ম্যাডামসহ আরো অনেক শিক্ষক।আছেন ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জামাল স্যার, সাদ উদ্দীন স্যার প্রমুখ।

আসুন প্রতিজ্ঞা করি,আত্মবিশ্বাসী হই,জীবন সংগ্রামে নিজকে অবতীর্ণ করি।একদিন সফলতা আসবেই আসবে।

নিউজটি শেয়ার করুন আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায়..

© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৯ সিলেট দর্পণ ।