শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৬ অপরাহ্ন

বিজ্ঞপ্তিঃ
আমাদের সিলেট দর্পণ  ২৪ পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে , আমাদেরকে আপনাদের পরামর্শ ও মতামত দিতে পারেন news@sylhetdorpon.com এই ই-মেইলে ।
ফাঁদে বাংলাদেশিঃ কম্বোডিয়ায় দুর্বিষহ জীবন

ফাঁদে বাংলাদেশিঃ কম্বোডিয়ায় দুর্বিষহ জীবন

ইসমাইল হোসেন। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থানায় বাড়ি। গ্রামের সহজ সরল জীবনযাপন ছিল তার। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে না পেরে বিদেশ পাড়ি দিয়ে উপার্জন করবেন বলে ভেবেছিলেন। খোঁজ পান কম্বোডিয়ায় শ্রমিক পাঠানো হবে। জমিজমা বিক্রি করে দালালের হাতে টাকা তুলে দিয়ে পাড়ি জমান কম্বোডিয়া। কম্বোডিয়ার মাটিতে পা রাখতেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ইসমাইলের। কাজ তো পেলেনই না বরং ঘরবন্দি অসহায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
যে উপার্জনের আশায় ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশ গেলেন তা না করে উল্টো বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে চলতে হচ্ছে।
 
কম্বোডিয়ায় ইসমাইলের মতোই তিন থেকে চারশ’ বাংলাদেশির এমন দুর্বিষহ দিন কাটছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দালালের হাত ধরে না বুঝে কম্বোডিয়ায় যান তারা। কোম্পানির কাজ দেয়ার কথা বলে নিয়ে গেলেও সেখানে গিয়ে কোনো কাজ পান না ভুক্তভোগীরা। বরং অবৈধ হয়ে ঘরবন্দি জীবন কাটছে। আর কেউ কেউ ফিরে এলেও নিজের খরচেই আসতে হয়েছে।
 
জানা যায়, কম্বোডিয়ায় বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ দেয়ার নাম করে একটি দালাল চক্র গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে টার্গেট হিসেবে নিয়েছে। এরই মধ্যে এই চক্রটি অন্তত বিশ জনেরও বেশি মানুষকে কম্বোডিয়ায় পাঠিয়েছে। ভ্রমণ ভিসায় নিয়ে গিয়ে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। বাংলাদেশ থেকে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের সাইফুল, রুহুল আমিন, ঢাকার পল্লব ও চাঁপাই নবাবগঞ্জের বাক্কার আলী এই দালাল চক্রের অন্যতম হোতা বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। তাদের দাবি, এই দালাল চক্র একযোগে একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় কাজের ভিসায় নিয়ে যাবেন বলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে।
 
ভুক্তভোগীদের একজন মো. ইসমাইল হোসেন। বর্তমানে তিনি কম্বোডিয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ১৪ মাস আগে সেখানে যান তিনি। কিন্তু কাজের আশায় গিয়ে কম্বোডিয়ায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ইসমাইল কম্বোডিয়া থেকে হোয়াটস অ্যাপে বলেন, ১৪ মাস আগে জমিজমা বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করি। তারপর স্থানীয় দালাল সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সাইফুল তার সহযোগী চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাক্কারের কাছে নিয়ে যায়। আমাকে বলা হয়, কাজের ভিসায় নিয়ে যাবে কম্বোডিয়ায়। কিন্তু এখানে আমাকে ভিসা রিনিউ করে দেয়নি। পাসপোর্টও দেয়নি। আমি কোনো কাজও করতে পারিনি। উল্টো দেশ থেকে টাকা নিয়ে এসে আমাকে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। ঘর থেকে কোনোভাবে বের হয়ে ধরা খেলেই দিনে দশ ডলার হিসেবে যতদিন পালিয়েছিলাম সে পরিমাণ জরিমানা দিতে হবে। বাক্কারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও আমি এর কোনো সুরাহা করতে পারিনি। ইসমাইল আরো জানান, বাক্কারের বাড়ি চাঁপাই নবাবগঞ্জের নামোশংকরবাটিতে। এই ব্যক্তিসহ কয়েকজনের সহযোগিতায় কম্বোডিয়ায় ঘরবন্দি অবস্থায় আরো ছয়জন রয়েছেন। যারা খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
 
চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে কম্বোডিয়ায় পাড়ি জমান আরেক ব্যক্তি আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, স্থানীয় দালাল মেরাজের মাধ্যমে এখানে এসেছি। এসে কাজ পাইনি। এখন ঘরবন্দি অবস্থায়। বাইরে বের হলেই পুলিশ ধরে নিয়ে আটকে রাখবে।
 
চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে কম্বোডিয়ায় যান কামরুল। ইসমাইলের মতো তিনিও বাক্কারের খপ্পরে পড়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। কামরুল বলেন, বাক্কারের মাধ্যমে ভিটেমাটি বিক্রি করে কম্বোডিয়ায় এসেছি। এখানে এসে কোনো কাজ পাইনি। এখন আটকে আছি। পাসপোর্ট নাই। ঘর থেকে বের হলে ধরা পড়ে যাবো। আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।
 
ইসমাইলের সঙ্গে একই কক্ষে বন্দি রয়েছেন রাশিদুল ইসলাম, আবদুল আওয়াল ও এমদাদ হোসেন নামের তিন ব্যক্তি। তারা প্রত্যেকেই দালালের খপ্পরে পড়ে কম্বোডিয়ায় আটকে আছেন।
বাক্কার দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে কম্বোডিয়া গিয়ে ফেরত এসেছেন এমন একজনও অভিযোগ করেছেন। তার নাম আশিক। বাড়ি মাগুরায়। আশিক বলেন, আমাকে কম্বোডিয়ায় নিয়ে যায় কাজের কথা বলে। কিন্তু গিয়ে দেখি একমাসের ট্যুরিস্ট ভিসা। ধারদেনা করা পুরো টাকাটা আমার জলে যায়। বাক্কারকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছি। সে আমাকে কোনো কোম্পানিতে কাজ দিতে পারেনি। ২৯ দিনের মাথায় আমাকে দেশে আসতে হয়।
চাঁপাই নবাবগঞ্জের শাহজাহানের অবস্থাও একই। বাড়িতে আবাদি জমি বিক্রি করে দালালের মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাজ না পেয়ে আবার ফিরে আসতে হয়। এখনো সে টাকা উদ্ধার করতে পারেননি শাহজাহান। তিনি  বলেন, সংসারের খরচ টানতে কষ্ট হয়ে যেত। তাই বিদেশ গিয়ে কিছু করতে চাইলাম। কম্বোডিয়ায় গিয়ে আবার ফিরে আসতে হয়েছে। দালাল যে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে গেছে সে টাকা এখনো পাইনি।
 
দালালের খপ্পরে পড়ে টাঙ্গাইলের কালাম নামের এক ব্যক্তিকে মালয়েশিয়ায় গিয়ে আবার ফিরে আসতে হয়। এ জন্য তাকে খোয়াতে হয়েছে দশ লাখ টাকা। তিনি বলেন, বাক্কার মায়েশিয়ায় নেয়ার নাম করে টাকা নেয়। মালয়েশিয়ায় গিয়ে আবার ফিরে আসছি। কোনো কোম্পানিতে কাজ করতে পারিনি। আমার পুরো টাকাই জলে গেছে। এখনো টাকা বুঝে পাইনি।
 
এসব বিষয়ে দালাল চক্রের সদস্য বাক্কার আলীর সঙ্গে মানবজমিনের মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি জানান, যারা অভিযোগ করছে তারা অযথা অভিযোগ করছে। আমি কারো টাকা মেরে খাইনি। তাদের ভিসার মেয়াদ তারা বাড়াতে পারেনি। সেখানে গিয়ে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হয়। তারা সেটা করেনি। মাঝখানে আমার বদনাম করা হচ্ছে। দালাল চক্রের আরেক সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি শুধু দুজন লোককে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। সেটা বাক্কারের মাধ্যমে। ব্যবস্থা বলতে আমি কোনো লেনদেনের মধ্যেও ছিলাম না। তাদেরকে লোক দেখিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার এখন বদনাম। আমি এক টাকাও লাভ নেইনি। তাহলে আমার দোষ কেন হবে?

নিউজটি শেয়ার করুন আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায়..

© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৯ সিলেট দর্পণ ।