শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৪ পূর্বাহ্ন

বিজ্ঞপ্তিঃ
আমাদের সিলেট দর্পণ  ২৪ পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে , আমাদেরকে আপনাদের পরামর্শ ও মতামত দিতে পারেন news@sylhetdorpon.com এই ই-মেইলে ।
বাঁশকোঁড়ল ও বংশলোচন- জায়েদ ফরিদ

বাঁশকোঁড়ল ও বংশলোচন- জায়েদ ফরিদ

বিশেষ প্রবন্ধ ◾ বাঁশের কোঁড়ল, বাঁশকোঁড়ল অর্থাৎ বাঁশ গাছের নতুন কুঁড়ি বা অঙ্কুর। শুদ্ধ বাংলায় এটি ‘বংশকোরক’ হলেও সাধারণ্যে এই শব্দের ব্যবহার নেই। গোটা উপমহাদেশে খাদ্য হিসাবে বাঁশকোঁড়ল প্রাচীন হলেও আদিবাসীদের মধ্যেই এর ব্যবহার সীমিত থেকেছে। হাল আমলে আদিবাসীদের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের নামিদামি রেস্টুরেন্টে এটা ব্যাম্বু শ্যুট (Bamboo shoot) নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। মচমচে ভিন্ন স্বাদের এই সবজি বেশ স্বাদ করেই খায় লোকজন, যদিও অধিক ভোজনে পেট ফেঁপে যেতে পারে।

উপমহাদেশে এই কোঁড়ল খাওয়ার একটি নিয়ম হলো, কচি বাঁশের অঙ্কুরের উপর মাটির হাঁড়ি চাপা দিয়ে চারদিক থেকে মাটি লেপে দেয়া যাতে ভেতরে আলোবাতাস প্রবেশ করতে না পারে। এমতাবস্থায় মাসখানেক পরে হাঁড়ি ভাঙলে দেখা যায় ভেতরের অঙ্কুর সাদা বাঁধাকপির আকৃতি ধারণ করেছে যা খেতেও সুস্বাদু। যে সব বাঁশকোঁড়ল পাতিল চাপা দেয়া হয় না সেগুলোতে তিতার পরিমাণ বেশি থাকে। উচ্চতায় দুই ফুটের বেশি হলে এটা খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে, কারণ ফাইবার শক্ত হয়ে পড়ে এবং স্বাদে কটুতা বৃদ্ধি পায়। বাজার থেকে বাঁশকোঁড়ল কেনার সময় দেখে নিতে হয়, কোঁড়ল কচি কি না। যে সব কোঁড়লের উপরিভাগ সবুজ হয়ে যায় সেগুলো তিতা হয় বেশি, যেগুলো বাঁকা থাকে বা আকারে ছোটো হয় সেগুলো তেমন তিতা হয় না।

যতই কচি হোক বাঁশকোঁড়ল সরাসরি খাওয়া যায় না। এগুলো অনেকে দুদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখেন এবং লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে নেন কারণ এর ভেতরে ‘সায়ানোজেনিক গ্লাইকোসাইড’ থাকে যা থেকে তৈরি হয় বিষাক্ত ‘হাইড্রোজেন সায়ানাইড’। এই হাইড্রোজেন সায়ানাইড থাকে অ্যামন্ড বাদাম (almond), কাজু বাদাম (cashew nut) এবং কাসাভাতে। এই সায়ানাইড জলে দ্রবীভূত হয়ে নষ্ট হয়। তাই ভাজা বাদাম বা কাসাভাতে সায়ানাইড থেকে যায়। উল্লিখিত বাদামগুলো উপকারি হওয়া সত্ত্বেও বেশি খাওয়া যায় না, হয়তো ৬-৭ টার বেশি নয়। এই বিষ কাসাভার ভেতরেও থাকে বলে তা রৌদ্রে শুকিয়ে ও জ্বাল দিয়ে শুদ্ধ করে নিতে হয়। কচি বাঁশের আত্মরক্ষার জন্যই গাছ এমন বিষাক্ত হয়ে থাকে যাতে গরু ছাগল তা খেতে না পারে।

জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই সবজি সহজে পাওয়া যায়। শীতকালেও কিছু বাঁশকোঁড়ল পাওয়া যায় যেগুলোতে তিতার পরমাণ কম এবং খেতে সুস্বাদু। ভারতেই বাঁশের সবচেয়ে বেশি প্রজাতি দেখা যায়। অনুমিত হয়, ভারত থেকেই বাঁশের নানা ব্যবহার ও প্রজাতি চীনে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবীতে এখন বাঁশজাত দ্রব্য ও খাদ্য রফতানিতে চীনই সর্বাগ্রে। অনেক উদ্ভিদবিদ মনে করেন, চীনই বাঁশের আদিনিবাস যেখানে অতি প্রাচীনকালেই কাগজ, পোশাক ও খাদ্য ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে চীনের পরপর বাঁশজাত দ্রব্য রফতানিতে এগিয়ে যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েৎনাম, মিয়ানমার ও জাপান। এত বাঁশের আখড়া থাকা সত্ত্বেও ভারত কিন্তু বাঁশের ব্যবসায়ে পিছিয়ে আছে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মিজোরাম, মণিপুর, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড ও বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, রুমা ও থানচিতেও বাঁশকোঁড়ল খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয়। বাঁশকোঁড়লের কিছু আঞ্চলিক খাবারের নাম উষই, সইবাম, মেসু, হিরিং ইত্যাদি। আসামে মসুরের ডালের সঙ্গে রসুন-মরিচ দিয়ে ভাজা বাঁশকোঁড়ল যোগ করা হয়। চীনারা সয়া সস, তিলের তেল, ভিনেগার দিয়ে স্টার-ফ্রাই করে খায়। থাইল্যান্ডে খুব পাতলা স্লাইস করে সালাদও খাওয়া হয়। সারা পৃথিবীতে স্যুপের সঙ্গে বাঁশকোঁড়লের ব্যবহারই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি। ঠিকমতো প্রস্তুত করতে পারলে এর স্বাদে মিষ্টতা আসে এবং একটা অদ্ভুত কাষ্ঠল স্বাদ পাওয়া যায়। জাপানে বাঁশকোড়ল খাওয়া হয় মিসো পেস্ট দিয়ে।

মিসো ছাড়া কোনো জাপানি খাবারের কথা ভাবাই যায় না। কন্ডিমেন্ট, সিজনিং, সালাদের ড্রেসিং হিসাবে মিসো অনেক খাবারেই যোগ করা হয়। রান্না শেষ হবার সামান্য কিছুক্ষণ আগে এটা মেশানো হয় যাতে ফ্লেভার ভাল থাকে। মিসো তৈরি হয় প্রধানত সয়বিন ফারমেন্ট করে যার সঙ্গে মেশানো হয় ‘কজি’ ফাঙ্গাস (Spergiillus oryzae)। মিসো গাঁজাতে সাতদিন থেকে দু’বছর পর্যন্ত সময় নেয়া হয়। প্রায় ১৩শ বছর থেকে জাপানে এই মিসো তৈরি হচ্ছে। শুধু স্বাদ নয়, এতে উপকারি অনেক উপাদানের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন B-12 ও ভিটামিন K, যাদের অন্যতম কাজ ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধ করা।

যে কয়েকরকম বাঁশ থেকে বাঁশকোঁড়ল পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম Bambusa vulgaris (বাঁশিনি বাঁশ, যা থেকে বাঁশি তৈরি হয়), B. tulda (তল্‌দা বা তল্লা বাঁশ যা ফাঁপা বলে বেড়ার চটা হিসাবে ব্যবহৃত হয়, B balcooa (ভেলকি বাঁশ), Dendrocalamus hamiltonii, D. strictus (কাঁড়াইল বাঁশ),
Bambusa arandinacea (দেখতে কিছুটা আঁকাবাঁকা, বেউড় বাঁশ বা কাঁটা বাঁশ দিয়ে আগে গড় বা বিস্তীর্ণ এলাকায় দুর্ভেদ্য বেড়া দেয়া হতো।)

বেউর বাঁশের কোনো কোনো সন্ধিতে পাওয়া যায় অতি মূল্যবান ঔষধ বংশলোচন বা তাবাশির। এই বিরল ওষুধ বংশকর্পূর, বনশর্করা, Manna, Green gold of forest ইতাদি নামেও পরিচিত। আনুমানিক ৩৩ প্রজাতির বাঁশ থেকে এই তাবাশির পাওয়া যায়। স্ত্রী বাঁশ, যেগুলো ভেতরে একটু বেশি ফাঁপা থাকে সেগুলোতেই দেখা দেয় এই তাবাশির। এর অশেষ গুণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কমা বা স্ট্রোক পেশেন্ট, প্যারালাইসিস, হাঁপানি রোগে এর ব্যবহার।

দীর্ঘকাল পরে পুষ্ট বাঁশের সন্ধি থেকে উদ্গত সিলিকন ডাই-অক্সাইড, গ্লাইকোসাইড, লাইম, পটাশ ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি হয় মিষ্ট বংশলোচন। বংশলোচন জলে দ্রবীভূত হয় না কিন্তু অ্যালকোহলে গলে যায়। একে ফারসিতে বলা হয় ‘তাবাশির’। সংস্কৃত ত্বক-ক্ষীর (Bark milk) থেকেই সম্ভবত তাবাশির শব্দের উৎপত্তি। হাজার হাজার বছর ধরে আরব বণিকরা ভারত থেকে এই তাবাশির সংগ্রহ করে নিয়ে যেত। দ্বাদশ শতকে এই রফতানির কেন্দ্রবিন্দু ছিল মহারাষ্ট্র। এখন বাজারে বংশলোচন বা তাবাশির নামে যা বিক্রি হয় তার অধিকাংশই নকল। সোডিয়াম সিলিকেট আর অ্যামোনিয়াম সিলিকেট জলে মিশিয়ে শুকিয়ে তৈরি করা হয় নকল বংশলোচন।

বাঁশকোঁড়ল কতটা উপকারি খাদ্য তা নিয়ে উপমহাদেশে অতীতে কখনোই বিশদ গবেষণা হয়নি। সংহিতা আর নিঘন্টুকারগণ মনগড়া বিপরীতার্থক কথা লিখেছেন, অতএব চিকিৎসাক্ষেত্রে এর ব্যবহারও নির্ভুল হয়নি। চরক ও সুশ্রুত সংহিতায় বলা হয়েছে বাঁশকোঁড়ল কফ-পিত্ত বর্ধক, গুরু ও রুক্ষ্ণ আবার বাগভট, রাজনিঘন্টু, ধন্বন্তরিতে বলা হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত, বাঁশকোঁড়ল কফ-পিত্তনাশক, লঘু ও শীতল। এখন নতুন করে এর গবেষণা না হলে আমাদের পিছিয়ে থাকতে হবে, জ্ঞানের অভাবে হারাতে হবে অমূল্য অনেক কিছুই। পরিশেষে একটি সাবধানবাণী হলো, বাঁশকোঁড়ল নারকেল দিয়ে সুস্বাদু রান্না করা গেলেও দুধ মেশালে তা ভীষণ বিষাক্ত হয়ে পড়ে।

নিউজটি শেয়ার করুন আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায়..

© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৯ সিলেট দর্পণ ।