শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩৪ অপরাহ্ন

বিজ্ঞপ্তিঃ
আমাদের সিলেট দর্পণ  ২৪ পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে , আমাদেরকে আপনাদের পরামর্শ ও মতামত দিতে পারেন news@sylhetdorpon.com এই ই-মেইলে ।
‘এক সিনিয়র কর্মকর্তার নির্দেশে পালিয়েছিলাম’-এসআই আকবর

‘এক সিনিয়র কর্মকর্তার নির্দেশে পালিয়েছিলাম’-এসআই আকবর

দর্পণ ডেস্ক : কানাইঘাটের দুর্গম একটি এলাকা। অনেকটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নও। সকাল তখন ৯টার একটু পর। এমন সময় এস আই আকবরকে দেখতে পায় স্থানীয়রা। সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা দিয়ে সে ঘুরাফেরা করছিলো। স্থানীয়দের সন্দেহ হয় তাকে ঘিরে। অচেনা এক লোক।

এ সময় সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা তাকে ধরে ফেলেন। স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই তাকে চিনে ফেলেন। এই সেই আকবর। বিষয়টি সন্দেহ হওয়ার পর তারা তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ভয় দেখান। পরে আকবর নিজেও স্বীকার করে সে আকবর। এরপর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ক্ষোভ দেখা দেয় স্থানীয়দের মধ্যে। কেউ দড়ি নিয়ে আসেন। কেউ বা তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন। এক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয় দড়ি। সেই দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলা হয়। খবর পেয়ে ছুটে যায় পুলিশ ও বিজিবি। বিক্ষুব্ধ জনতা দুপুরের পর আকবরকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করে। ডোনা সীমান্তের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সকালের দিকে তারা অচেনা এক যুবককে সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ড এলাকায় ঘুরাঘুরি করতে দেখেন। এতে দুই দেশের সীমান্ত এলাকার মানুষের চোখে তার গতিবিধি দেখে সন্দেহ হয়। তারা তাকে আটক করেন। পরে সে নিজের পরিচয় জানায়। এ সময় স্থানীয়রা ভিডিও ধারণ করেন। এর মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা গেছে ২৯ দিন ধরে পলাতক থাকা আকবরের সেই জৌলুস আর নেই। তার পরনে ছিল খয়েরি রংয়ের একটি শার্ট ও কালো প্যান্ট। মুখে দাড়ি ও গোঁফ। ফলে তাকে প্রথম দেখাতেই কেউ চিনতে পারবে না। আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। স্থানীয় লোকজন দড়ি নিয়ে এসে তাকে বেঁধে ফেলে। এ সময় আকবরের চোখে ছিল ভয়। সে বার বার তাকে না বাধার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছিলো। প্রাণভিক্ষা চাইছিলো। এরপর স্থানীয়রা তাকে আটক করে একটি পাহাড়ি ঝরনা পাড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়। আরো একটি ভিডিওতে ধারণ করা ছিল- আটক হওয়া আকবরের ইন্টারভিউ। সীমান্ত এলাকার বাঙালি ও খাসিয়ারা তাকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। এ সময় কেঁদে কেঁদে আকবর তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে আকবর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিল। তবে সীমান্ত এলাকার মানুষ তার কথা বিশ্বাস করছিল না। এদিকে দুপুরের পর বিজিবি ও পুলিশের হাতে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা এস আই আকবরকে হস্তান্তর করে। জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিনও। ডোনা সীমান্ত থেকে আটক করে এস আই আকবরকে প্রথমে নিয়ে আসা হয় কানাইঘাট থানায়। প্রায় এক ঘণ্টা পর বিকালের দিকে কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় তাকে সিলেটের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, ১১ই অক্টোবর রায়হান হত্যার দিনই বন্দরবাজার ফাঁড়ির দায়িত্বরত ইনচার্জ এস আই হাসানের কাছে অস্ত্র সহ সরঞ্জাম জমা দিয়ে সিলেট ছেড়ে পালায় এস আই আকবর। তার আগে সে সিসিটিভির ফুটেজ মুছে ফেলে। এরপর সে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত এলাকার মাঝেরগাঁও দিয়ে সে ভারতে পালিয়ে যায়। সহযোগী আব্দুল্লাহ আল নোমান তাকে ভারত পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। গতকাল সকালে কানাইঘাট সীমান্ত এলাকায় এলে স্থানীয় জনতা তাকে আটক করে। আটকের পর খাসিয়া ও বাঙালিরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় এস আই আকবর জানিয়েছে, ‘মাঝেরগাঁও দিয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। ওখানে তার এক পরিচিত জনের বাসায় অবস্থান করে।’ এদিকে আটকের পর গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট জেলা পুলিশের কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমদ ও পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন আহমদ। এ সময় আকবরকে আটকের কথা জানিয়ে সিলেটের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, আকবর সীমান্ত এলাকা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এ কারণে কানাইঘাট সীমান্ত এলাকায় সাদা পোশাকে পুলিশের টহল ছিল। জেলা পুলিশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এস আই আকবরকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় পুলিশের নির্ভরযোগ্য বন্ধু ছিল। আকবরকে পুলিশ সীমান্তের বাংলাদেশ অংশ থেকে গ্রেপ্তার করেছে। আকবরকে জেলা পুলিশের হাতে কেউ হস্তান্তর করেনি বলে জানান তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসপি জানান, আকবর ভারত থেকে আসছিল কিনা কিংবা সে ভারতে পালাচ্ছিলো কিনা- এসব বিষয় তাকে পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে। তিনি জানান, আকবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাতেই তাকে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান তিনি। আকবরকে পালাতে যারা সহযোগিতা করেছে তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান তিনি। সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি মহোদয় আকবরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাসী। অপরাধ যেই করুক তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আকবরকে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

এক সিনিয়র কর্মকর্তার নির্দেশে পালিয়েছিলাম’: ঘটনার পর এক সিনিয়র কর্মকর্তার নির্দেশে পালিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন সিলেটের রায়হান হত্যা মামলার প্রধান আসামি বরখাস্ত হওয়া এস আই আকবর হোসেন ভুঁইয়া। সোমবার দুপুরের পর সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকার খাসিয়াদের কাছে আটকের পর সে স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদে এ কথা জানিয়েছে। সে জানায়, ‘আমাকে এক সিনিয়র অফিসার বলছিলো তুমি আপাতত চলে যাও। কয়েক দিন পর আইসো। দুই মাস পরে মোটামুটি পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এ কারণে আমি চলে যাই।’

গ্রেপ্তারের পর আকবর দাবি করে- রায়হানকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় আটক করা হয়েছিলো। তাকে কাস্টঘর এলাকার লোকজন গণপিটুনি দেয় বলে দাবি করে। তবে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্তের খাসিয়াদের জেরার মুখে কেন পালিয়েছিলো প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, ‘সাসপেন্ড করছে, অ্যারেস্ট করতে পারে। এ কারণে পালিয়েছিলাম।’ কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তের মাঝেরগাঁওয়ের ওদিকে ভারতে পালিয়েছিলো বলে জানায় আকবর। ওখানে তার এক পরিচিত পরিবার রয়েছে বলে দাবি করে সে।

রায়হানের মায়ের দাবি:
আকবর গ্রেপ্তার হওয়ার পর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম। এস আই আকবরকে গ্রেপ্তার করার পর আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘একবার আকবরকে আমি ছুঁয়ে দেখতে চাই। এর কারণ আকবর মানুষ কিনা- সেটি আমি পরীক্ষা করতে চাই। কোনো মানুষ এভাবে কোনো মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে না।’

রায়হানের মা জানান, ‘এস আই আকবরকে গ্রেপ্তার করায় তিনি সন্তুষ্ট। কিন্তু তার বিচার প্রকাশ্য জনগণের সামনে সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে করতে হবে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে। তবেই রায়হানের আত্মা শান্তি পাবে। তিনি বলেন, আকবরকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সেটি আকবর বলেছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তাসহ আকবরকে সহায়তাকারী সাংবাদিক নোমানের শাস্তি দাবি করেন তিনি। বলেন, যারা অপরাধীকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে তারাও সমান অপরাধী।

এসপি অফিসের সামনে শত শত মানুষের ভিড়:
রায়হান হত্যার অন্যতম হোতা এস আই আকবর হোসেন গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে সিলেটের শত শত মানুষ বন্দরবাজারস্থ পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে ভিড় করেন। বিকাল থেকেই তারা ফাঁড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে রায়হানের খুনি এস আই আকবরের শাস্তি দাবি জানান। এ সময় কেউ কেউ আটক আকবরকে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় কয়েকজন স্থানীয় মানুষ আকবরকে গ্রেপ্তার করায় সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিনকে ধন্যবাদ জানান। তারা বলেন, পুলিশ সুপার আন্তরিক হওয়ার কারণেই আকবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তারা সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় প্রকাশ্যে সকলের সামনে আকবরকে ফাঁসি দেয়ার দাবি তুলেন।

বলেন- দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে আকবরের মতো আর কেউ পুলিশ হেফাজতে মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করবে না। এদিকে সন্ধ্যায় সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন রাস্তায় অবস্থান করা স্থানীয় জনতাকে শান্ত করতে যান। এ সময় তিনি বলেন, আপনাদের দাবি ছিল আকবরকে গ্রেপ্তার করা। আমরা আকবরকে গ্রেপ্তার করেছি। তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার পর এখন বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায়..

© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৯ সিলেট দর্পণ ।