শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৫:৪৫ অপরাহ্ন

বিজ্ঞপ্তিঃ
আমাদের সিলেট দর্পণ  ২৪ পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে , আমাদেরকে আপনাদের পরামর্শ ও মতামত দিতে পারেন news@sylhetdorpon.com এই ই-মেইলে ।
একটি ঝরা ফুলের ফিরে আসার গল্প – মনিকা দাস

একটি ঝরা ফুলের ফিরে আসার গল্প – মনিকা দাস

একটি ঝরা ফুলের ফিরে আসার গল্প
মনিকা দাস

সাল ২০২০। সুপাতলা গ্রামে এক ভাই ও এক বোন নিয়ে মালার (ছন্দ নাম) সংসার। মা খুব কষ্ট করে তাদের দুই ভাই বোনের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাবা যেন থেকেও নেই মালার। একদিন কথা প্রসঙ্গে মালা জানলো একটা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে নাকি তার বাবা পলাতক আছেন। তাদের সাথে কোন যোগাযোগ এখন আর নেই তার। প্রায় সময় মালার মা স্কুলে আসতেন ছোট ছেলেটাকে নিয়ে। টুকটাক সংসারের কষ্ঠের কথা বলে কেঁদেই ফেলতেন। বলতেন এতে কষ্ট আর সহ্য হচ্ছেনা ম্যাডাম। অভাবের সংসারে ওদের পছন্দ মতো কোন খাবার আমি দিতে পারি না। ওর এক চাচা নাকি মাঝে মধ্যে তাদের বাজার করে দিয়ে যান। তাও মাসে একবার। সে তখন ৩য় শ্রেণির ছাত্রী। একদিকে সংসারের অভাব অন্যদিকে মালার দিন দিন বড় হয়ে যাওয়ার ফলে তার মায়ের মালাকে নিয়ে চিন্তা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালে মালা অনেকটা বড় হয়ে গেছে। সে এখন ৫ম শ্রেণির ছাত্রী। সহপাঠীদের সঙ্গে হেসে খেলে দিন ভালোই যাচ্ছিল তার হঠাৎ তার সহপাঠীরা খেয়াল করল মালা যেন ইদানিং আনমনা হয়ে থাকে সবার সাথে আগের মতো আর খেলা করে না পড়াশুনায় ও সে যেন আগের মতো করতে চায় না। সবসময় কিছু একটা নিয়ে চিন্তায় থাকে। স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে বাহিরে কারো সাথে ইশারায় কথা বলে সেটা তার বান্ধবীরা খুব ভালো করে খেয়াল করেছে। তারাও তাকে খুব চোখে রাখাতে লাগলো। এদিকে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা গোল্ডকাপে পৌরসভা পর্যায়ে খেলার জন্য ছেলে-মেয়েরা প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা ছেলে বিদ্যালয়ের মাঠের একপাশে মালার সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে। তার বান্ধবীরা ও যেন মালাকে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দূর থেকে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। তার বান্ধবীদের দেখে মালা তাড়াহুড়া করে চলে আসলো। ছেলেটিও তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেল। আমি মালাকে ডেকে এনে ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করলাম। দেখলাম ওর চোখে মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন। ভয়ে ভয়ে বলল ওর চাচার ছেলে পরে পৌরসভা পর্যায়ে খেলা থাকার কারণে ওকে নিয়ে আর কোন কথা না বাড়িয়ে ছেলে-মেয়েদের খেলার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। পরের দিন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে খেলায় অংশ গ্রহণের জন্য সবাই প্রস্তুত হচ্ছি। হঠাৎ মালা এসে বললো সেও বান্ধবীদের খেলা দেখার জন্য মাঠে যেতে চায়। অনেক অনুরোধের পর তাকে নিতে রাজি হলাম। ছেলেদের খেলা প্রথমেই শুরু হলো। হঠাৎ মালা এসে বলে বাহরুমে যাবে। আমি আর একটা মেয়ে সাথে দিয়ে মাঠের পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে বলি। অনেকক্ষণ ধরে না আসার কারণে আমিই এগিয়ে গেলাম তাকে দেখার জন্য। আমি দেখলাম আগের দিনের সেই ছেলেটার সাথেই কথা বলছে। আমাকে দেখে মালা তাড়াতাড়ি করে আমার কাছে চলে আসলো। এদিকে খেলা চলার কারণে ওর দিকে ভালো করে মন ও দিতে পারতেছি না। পাশে থাকা আমার অন্যান্য শিক্ষকদের ওর দিকে ভালো করে খেয়াল রাখার কথা বললাম। প্রতি বারের ন্যায় এইবারও আমার বিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রী বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। সকল ছাত্র/ছাত্রীকে যথারীতি বাড়িতে পৌছে দিয়ে আমরা ও সবাই বাড়ি ফিরলাম। পরদিন সবাই চ্যাম্পিয়ান হওয়ার আনন্দে মেতে উঠলো। আমি মালাকে ডেকে ছেলেটার ব্যাপারে জানতে চাইলে মালার সাথে আসা ওর বান্ধবী বলে ম্যাডাম ছেলেটা ওর ভাই না। স্কুলের বাহিরে আমড়া বিক্রি করে। তাদের কথায় মালার সাথে ঐ ছেলেটার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। আমরা তাকে অনেক বুঝালাম। মালা এই ব্যাপারটা আর পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আশ^স্ত করল। কয়েকদিন ভালোই কাটলো। হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম ও আমাদের মিথ্যা বলেছে। উপায় না দেখে ওর মাকে খবর দিলাম। ওর মা অনেক বকাবকি করে ওকে নিয়ে বাসায় চলে গেল। কয়েকদিন ধরে মালা আর স্কুলে আসতেছে না। তার মাকে ফোন দিলে বলেন ও আর পড়ালেখা করতে চাচ্ছেনা। তিনি ও আর এই যন্ত্রনা সামাল দিতে পারবেন না তাই ওর পড়ালেখা বন্ধ থাকবে। বাধ্য হয়ে একজন শিক্ষক নিয়ে আমি ওদের বাড়িতে গেলাম। তাকে অনেকক্ষণ বুঝালাম ও কিছুতেই আর পড়তে চায় না। ওর মার ও কথা মেয়েকে আর পড়াতে চান না। আমরা কিছুতেই তাদের বুঝাতে পারছিলাম না। অনেক কিছু বুঝানোর পর কিছু ক্ষণ কান্না কাটি করে শান্ত হয়ে মালা বললো আমি পড়তো যাবো মেডাম। কিছুক্ষণের জন্য আমার মনে হয়েছিল এই তরতাজা ফুলটা কী অকালেই ঝরে পড়বে। আমরা আবার স্কুলে ফিরে আসলাম। পরের দিন মালা আসার অপেক্ষায় থাকলাম। পরের দিন মালা বিদ্যালয়ে আসলো। খেয়াল করে দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তার বন্ধুদের সঙ্গে মিশে আনন্দ করছে। সবকিছু ভুলে মালা আবারও মন দিয়ে পড়তে লাগলো। তাকে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হতে হবে। এই বোধ শক্তিটা সে অর্জন করতে পেরেছে। একদিন হঠাৎ সে এসে আমার হাত ধরে কাঁদতে লাগলো বললো ম্যাডাম আপনি যদি আমাকে না বুঝাতেন তাহলে অনেক বড় ক্ষতি করতে যাচ্ছিলাম। আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম তোমাকে পড়ালেখা করে অনেক বড় হতে হবে। আর চিন্তা করলাম এভাবে সঠিক পথ দেখানোর অভাবে কতো মালার মতো ফুল গুলো অকালে ঝরে পড়ে তার হিসাব কি আমরা রাখি! দেশের হাজার হাজার মালা লেখাপড়া কবে তাদের জীবন উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা আমরা কী করতেই পারিনা? বিদ্যালয়ের প্রতিটি নানা রঙ্গের ফুলের মতো শিশুদের নিয়ে একটা সুন্দর ফুলের মালা তৈরি হবে। তাদের সৌরভ ও সু-গন্ধে দেশ ভরে যাবে। আর কোন মালাকে যেন অকালে ঝরে পড়তে না হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায়..

© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৯ সিলেট দর্পণ ।